প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যেও আমার সারা শরীর ঘেমে গেল। বলে কি ব্রেন্ডা ? ওর সিক্স গ্রেডের মেয়ে লুইস আমার ছেলের সহপাঠি। আমার ফিলিপিনো বন্ধু ব্রেন্ডা ওর মেয়েকে শিখিয়েছে-‘ বয়ফ্রেন্ডের সাথে ডেটিং কর সমস্যা নাই! কিন্তু প্রেগন্যান্ট হবার ব্যাপারে সাবধান!’
আমাদের সময়ে আমরা যাকে বলতাম ভালোবাসা বা প্রেম, এখনকার ছেলেমেয়েরা বলে ‘ক্রাশ’। সিক্স গ্রেড পড়ুয়া আমার বড় ছেলে প্রায়ই স্কুল থেকে ফিরে জানায়-ওর ক্লাসে নতুন কে কার প্রতি ক্রাশ খেল। কে কাকে প্রপোজ করল। কে আবার রিজেক্ট হল- এই সব। কোন কিছু গোপণ করা যাবে না এই আদেশ থেকে সে স্কুল থেকে ফিরেই গড়গড় করে সব বলতে থাকে।
এরকম একদিন ও জানালো, ব্রেন্ডার মেয়ে লুইসের কথা। লুইস ওদের সেকশনে কলম্বিয়ান এক ছেলে এনজেলের প্রতি ক্রাশ হয়েছে। আমি আমার ছেলে মননকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কিভাবে জানলে?’
ও বলল- ‘ সবাই জানে। ওরা তো ছুটির পরে হ্যাং আউট করে।’
ইঙ্গিতে সেটাই জানাতে গিয়েছিলাম ব্রেন্ডাকে। ও আমাকে অবাক করে দিয়ে যেটা বলল, তার সারমর্ম হল – ওর এগারো বছর বয়সী মেয়ে প্রেম করছে, এটা নিয়ে সে অত চিন্তিত নয়, তার চিন্তা মেয়ে যেন সেক্সুয়াল ব্যাপারে সতর্ক থাকে!
আমার ছেলের দুই বন্ধুর মা মিতা আর পুতুলও স্কুলগেটে সব সময় থাকে আমার সঙ্গে। আমরা এক সঙ্গে বাসায় ফিরি। ব্রেন্ডার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দেখে ওরা খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। ব্রেন্ডাকে বিদায় দিয়ে একটু আগের কথাটা ওদের বললাম। মিতা আর পুতুলেরও আমার মতো হতভম্ব অবস্থা। মাত্র এগারো বছর বয়সী সন্তান আমাদের! ওদের এক সহপাঠিনীকে নিয়ে মায়ের এমন দুর্ভাবনা! কোনভাবে হজম হচ্ছিল না!
বাংলায় শব্দটার সঠিক প্রতিরূপ কি হবে জানি না, ইংরেজীতে বলা হয় ‘কালচারাল শক’। এগারো-বারো বছর বয়সী সন্তানদের সেক্স বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা আমাদের মতো বাঙ্গালী মায়েদের জন্য এক ধরনের কালচারাল শকই বটে। এই দেশে বেশীরভাগ স্কুলে সিক্স গ্রেডে ওঠার পরে ছাত্র-ছাত্রীদের সেক্স বিষয়ে ক্লাস করানো হয়। এটা হেলথ ক্লাসের একটা অংশ। সিটি এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের আলাদা বাজেট বরাদ্দ থাকে এই জন্য। ছেলে ও মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন, বয়সন্ধি:কাল, প্রজনন, কিভাবে গর্ভনিরোধক নিতে হয়, কিভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়- এসব শেখানো হয় এই ক্লাসে।
আমেরিকায় বসবাসকারী সাদা-কালো-হিসপ্যানিক ছেলেমেয়েরা এগারো-বারো বয়স থেকেই প্রেমে পড়া শুরু করে। এখানে শারীরিক সম্পর্ককে প্রেম থেকে আলাদা করা হয় না। যে কারনে ভিডিওর মাধ্যমে যৌনশিক্ষা বিষয়ক ক্লাস করানো হয়! নানান সংস্কৃতি থেকে আগত সন্তানদের মধ্যে যেন কোন জটিলতা তৈরী না হয়, তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ মায়েদের কাছে অনুমতি চায় লিখিত সম্মতি দেবার জন্য। বাঙ্গালী অনেক মায়েরা অনুমতি দিতে চায় না। তারা ভয় পায়, তাদের এই কচি সন্তানটি এই বয়সে সব জেনে যাবে! তাহলে তো খারাপ হয়ে যাবে। রক্ষণশীল সমাজকাঠামো ও পরিবারব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা মায়েদের জন্য এটা একটা বড় ধাক্কা।
কেউ কেউ সেই ধাক্কা সামলাতে পারে। কেউ কেউ পারে না। যারা পারে না, তাদেরকে পরে পস্তাতে হয়। যেমন আমার ছেলের আরেক সহপাঠির মা জানাল, তার তিন মেয়ে। প্রথম মেয়েকে স্কুলে সেক্সুয়াল এডুকেশন ক্লাসে অংশ নেবার অনুমতি দেয়নি সে । তার ভাষায়, এটা তার জন্য ভুল হয়েছে। কেন ভুল হয়েছে? কারণ তাকে পরে সব কিছু শেখাতে হয়েছে মেয়েকে। দ্বিতীয় মেয়ের ক্ষেত্রে এই ভুল সে করেনি। ছোট মেয়েটি আমার ছেলের সঙ্গে পড়ে।
এখানকার বাংগালি মায়েদের মধ্যে স্পষ্টত: তিন ভাগ। কেউ সন্তানকে সেক্স এডুকেশন ক্লাসে দিতে চায়, কেউ দিতে চায় না আর তৃতীয় পক্ষ দ্বিধাগ্রস্ত। পরামর্শ করলাম আমার ছেলের আরেক বন্ধুর মায়ের সঙ্গে। ওর প্রথম সন্তানকে ইতিমধ্যে এই ক্লাসে দিয়েছে। ও আমাকে বলল, কেন তুমি তোমার ছেলেকে দেবে না। তুমি কি মনে কর না দিলে ও কিছু জানবে না! ও ঠিকই জানবে! তবে সেটা গোপণ করবে! আর সেক্স বিষয়ে শেখার জন্য স্কুলের চেয়ে ভালো জায়গা আর হতে পারে না।
আমার আরেক বন্ধু বলল, বেশীরভাগ বাঙ্গালী মায়েরা মনে করে শুধু মেয়ে সন্তানই যৌন হয়রানির শিকার হয়, এই ধারণা ঠিক না, ছেলে সন্তানরাও হয়। বাংলাদেশে ওর এক ভাইয়ের আট বছর বয়সী ছেলে সন্তানের কথা বলল। যাকে ব্যবহার করতে চাইতো ওর ভাই যে এ্যাপার্টমেন্টে থাকে তার দারোয়ান। ভাইয়ের ছেলেটি কিছু বুঝতো না। বলতেও পারতো স্পষ্ট করে। মাঝখান থেকে খুব চুপচাপ হয়ে যেতে লাগলো।
এভাবে অজ্ঞতা কিংবা ভুল জানার কারনে অনেক শিশুই হতাশা ও বিষন্নতায় ভোগে। সারাজীবন সেই ভয়ংকর স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আবার বাবা-মায়ের অতি খবরদারিতে সন্তানরা বিকৃতি নিয়েও বেড়ে উঠতে পারে। আমাদের মধ্যে বেশীরভাগ বাবা-মা, সন্তানকে সমলিঙ্গের কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বলি। যেমন ছেলে হলে ছেলেদের সঙ্গে, মেয়ে হলে বলি মেয়েদের সঙ্গে মিশতে। এদেশে এভাবে কেউ বলে না। বরং উল্টোটা করে। তারা ছেলে-মেয়ে উভয়কে বন্ধু ভাবতে শেখায়।
তার সন্তান যেন সমলিঙ্গের কারো প্রতি আকর্ষণ বোধ না করে এই ব্যাপারে খুব সচেতন থাকে এখানকার বাবা-মা। কারণ এটা এখানে একটা বিরাট সমস্যা। আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও এটা ঘটতে পারে। এক মায়ের কথা জানি, যে তার ছেলেকে সারাক্ষণ বলতো কোন মেয়ের সঙ্গে মিশবি না। কথা বলবি না। চৌদ্দ হাত দূরে থাকবি। এতে করে ছেলেটা দিনদিন লাজুক হয়ে যেতে লাগলো। ছেলেটির লাজুক ভাবসাব দেখে এখানকার হিসপ্যানিক ছেলেরা ওকে পছন্দ করল এবং ওকে ব্যবহার করতে শুরু করল। একটা সময় ছেলেটির মা যখন বিষয়টা টের পেলো, তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। প্রচন্ড আতংকে তারা আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে চলে গেল।
১৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, নিউইয়র্ক।
(অন্ধকারে একটা জোনাকী)
লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া
পাঠকের মতামত: